Subscribe

header ads

ধান ফরিং - দিব্যেন্দু নাথ

লিখেছেন  দিব্যেন্দু নাথ

( এক )
 জ্বলে ওঠা চুলা প্রায় বন্ধ। রোজগার নেই বললেই চলে। 'আনাজ-পাতি' যোগানের বড়ো অভাব। অভুক্ত মা-বাবার সঙ্গে আদুরে মেয়েটিও প্রায়ই আধপেটা থাকে।

 বন্যা যেমন ভাসিয়ে নেয়, তেমন কিছু ফেলেও যায়। গতবারের তোলা যে কয়টি ধান ছিল, তাও বাবা আশায় বুক বেঁধে, আচ্ছাদিত নরম পলিতে ফেলে দিয়েছে। ফলে ঝনঝনানিতে ভরা ধানের ভাঁড়ার শূন্য। নীরব ঘরের খুশি। ক্ষুধার জ্বালা। তবুও দিন চলে যায় ভোরের টানে। এ নিয়মে যেন, 'বাঁধা' নেই কোনোকালে। জন্ম মৃত্যুর মতো চিরন্তনী।

জন্ম-মৃত্যুর এই লম্বা পথ-ই যেন, সকল উত্থান-পতনের মূল্য নির্ণায়ক। এই পথের নিত্য সাথী ক্ষুধা। সে যখন ভয়ঙ্কর আনন্দ উল্লাসে মত্ত হয়ে ওঠে! মানুষ তখন নীরব উত্তেজনায় ধাবিত হয় দুশ্চিন্তার দিকে। কিন্তু নীরব ভূমিকায় থাকতে পারে না তার অন্তরাত্মা। তাকে ধাবিত করে কাজের সন্ধানে। অরবিন্দ ছুটে যেতে বাধ্য হয়। অনেক দূর যেতে হবে! পাহাড় পেরিয়ে গ্রাম, গ্রাম পেরিয়ে শহর।

ধর্মনগর শহরে ভালো কাজের বন্দোবস্ত করতে পারল না। পা রাখল রিকশার পাদানিতে। পায়ের 'বলে' রিকশার ছুটে শহরের আনাচেকানাচে, গলিপথে। শুরু হয় তুমুল সংগ্রাম, ঘাম ঝরে পথের ধুলোয়। কত অরবিন্দর ঘামে সিক্ত বালি। তাদের ফুট ফুট ঝরা ঘামের গন্ধ, ভোঁ ভোঁ করে পথে পথে। তার খোঁজ কেউ রাখে না....।

অরবিন্দ নিবিড় সম্পর্কের ডোরে বেঁধে নেয়, অপরিচিত পথচারীকে। এক নতুন অনুভুতি, 'বেশি পরিশ্রম - বেশি পাওনা বেশি উপার্জন '.....। কার্তিকের দুপুরে ক্লান্তি দূর করতে, বসে পড়ে জরাজীর্ণ এক কৃষ্ণচূড়ার তলে। এখানে অপেক্ষায়রত আগে থেকেই এক বরফওয়ালা। টিফিন অ্যাওয়ারে যাবে, সামনের স্কুল গেটে। সেও সংসার বাঁচাতে এই মরসুমে প্রথম বরফ ব্যবসায়ী হয়েছে। বর্তমানে শনিছড়ার বাঙালি কলোনির স্থায়ী বাসিন্দা। একসময় তার বসত ছিল অরবিন্দর প্রত্যন্ত গ্রাম গোপাল পুরে। বছর দুয়েক আগে, বন্যা কবলিত গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছে। পেশায় ছিল দিনমজুর ও ছুটাকামের শ্রমিক। ক্ষমতার পালা বদল হওয়ায় সরকারি কাজ প্রায় বন্ধ। ছুটাকামে অপর্যাপ্ত শ্রমিকের আমদানি। কাজ কম শ্রমিক বেশি। সংসার চলে না। তাই প্রতিদিন সকাল বেলা আসে কলোনি থেকে। বাক্স বন্দি বরফ ঠ্যালায় ঠেলে, ডুমুর বাজিয়ে বিক্রি করে। শহরের অলিগলিতে, স্কুল গেটে। মালিকের পাওনা-গণ্ডা বুজিয়ে, ঠ্যালা সমজিয়ে বাড়ি ফিরে সন্ধ্যায়।

( দুই )


পূর্ব পরিচিত দুজনের ভাব বিনিময়ে, আপ্লুত দুজন। এই মুহূর্তে ব্যাঘাত ঘটালো দশ বছরের সেই ছেলেটি। যে রোজ উদোম গায় হাফ পেন্ট পরে আসে। কিন্তু আজ এসেছে হাতে কঞ্চি নিয়ে একটি পরিত্যক্ত বাই-সাইকেলের টায়ারে, প্রহারের পর প্রহার করে। প্রতি দিনকার মতো বুকের ধড়ফড়ানি। আজ যেন একটু বেশি। অরবিন্দ কিছু একটা জিগ্যেস করতে যাচ্ছিল, থামিয়ে দিল ডুমুর শ্রমিক। এক টাকা দামের বরফটা পেতেই উল্টো পথে রওনা হল খুশিমনে। চাকা ঠেলতে ঠেলতে মিলিয়ে গেল রাস্তার মোড়ে।

ডুমর শ্রমিক এবার অরবিন্দকে বলতে লাগল, ছেলেটার মা-বাপ থেকেও নেই। নেশায় আসক্ত স্বামীর অত্যাচারে পরপুরুষের সঙ্গে পালিয়েছে তার মা মালতী। বাপটা এখন কোথায় থাকে! জানে না সে। রতনবাবুর সুপোরি খোয়ারে কাজ করত মালতী। এই সুবাদে ছেলেটাকে এখনও দু মুঠো ভাত খেতে দিচ্ছেন রতনবাবু। তবে বিনিময়ে কম বেশি ফায়-ফরমাসও কাটান।
- ছেলেটার ভবিষ্যত্ শেষ! - বলে অরবিন্দ গম্ভীর নিঃশ্বাস ছাড়তেই স্কুলের লেজারের বেল পড়ল। খানিকটা তৎপরতায় এগিয়ে গেল বরফওয়ালা। 'সংগ্রাম ভূমিতে যদি অন্য ব্যাপারি এসে যায়, তার বিক্রিবাট্টা গোল্লায় যাবে।

অরবিন্দ সৌজন্য পিস বরফ চুষতে চুষতে রিকশার পাদানিতে পা দেয়। তখনই এক পথচারী , পোস্ট অফিস যাওয়ার বায়না ধরল। বরফের অবশিষ্ট কাঠের শলাটা মাটিতে ফেলেই রওনা দিল তাকে নিয়ে।  পোস্ট অফিস সামনে আসতেই পরিচিত এক পিয়ন। চিঠি বিলি করে ফিরে এসেছে। যেসব চিঠি প্রাপককে, পাওয়া যায়নি! এমন কিছু চিঠি হাতে। অরবিন্দর দেখতেই, ব্যাগ থেকে একটি 'ডাক' বের করে তার হাতে দিল। অষ্টমপাশ অরবিন্দ প্রেরক স্থানে বাড়ির ঠিকানা দেখে, খুশি হয়েছে আবার ভয়ও পাচ্ছে। রিকশার ব্রেকে তারের বন্ধনীটা তুলে, ধীরে ধীরে চিঠি খুলে পাঠে ব্যস্ত হল। পিয়ন তখনও দাঁড়িয়ে। যত সময় যাচ্ছে, অরবিন্দর চেহারায় কেমন একটা অস্বাভাবিকতা ফুটে উঠছে। এবার দেখছে, জোরে-জোরে মাথা ঝটকাচ্ছে। নাঃ। অবশেষে হাতে কপালের চুলগুলো উপরে ঠেলে দাঁড়িয়ে রইল নীরবে। দু পা এগিয়ে এল পিয়ন। শহরের গায়ে তখন হেমন্তের পরন্ত সূর্য, সোনালি-রঙ ঢেলে দিচ্ছে অকৃপণতায়। চকমকিয়ে হাসছে, বড় বড় বিজ্ঞাপনের ডালা, আর উঁচু উঁচু ইমারতের তালা।

- কি ব্যাপার অরবিন্দ! বাড়ির চিঠি?
- হে বাবু।
- মেয়ে কেমন আছে?
- তেমন ভালো নেই বাবু। আমার পথ চেয়ে বসে আছে।
- একবার না হয়, গিয়ে দেখে এসো!
- তাই ভাবছি বাবু! পনেরো দিন পরে গেলে, ধানগুলো কেটে আসতে পারতাম! কিন্তু মেয়ের মা লিখেছে, মেয়েটা বড় উদাস দৃষ্টে তাকিয়ে রয় ক্ষেতের দিকে। আরো লিখেছে, 'সবেমাত্র ধানের শিষগুলো দুধেলা হয়েছে, ফড়িং এসে এইমাত্র ওড়াউড়ি শুরু করেছে....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ